উপমন্যু রায়
৯৭–এ সমাপ্ত নারায়ণ–যুগ। মাত্র তিনটে বছরের জন্য সেঞ্চুরি হল না। যদিও ইদানীং অশক্ত শরীর তাঁর জীবন চেতনাকে বারবার ব্যতিব্যস্ত করত। কয়েক বছর ধরে প্রায়ই তাঁকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকতে হয়েছে। তবু সদর্পে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে আসতেন। ফের খাতা–কলম নিয়ে বসে পড়তেন।
এবার আর পারলেন না। বেলভিউ ক্লিনিকেই তাঁর জীবনাবসান হল। হাঁদা, ভোঁদা, বাঁটুল, নন্টে, ফন্টে, কেল্টুদের অনাথ করে তাদের স্রষ্টা সুদূর সাহিত্যলোকে চলে গেলেন মঙ্গলবার বেলা সওয়া দশটায়।
আজ তাঁর সাহিত্য–অবদান নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। সত্যি কথা বলতে কী, বাংলা সাহিত্যে তিনি কোনও ইতিহাস তৈরি করেননি। কারণ, তিনি নিজেই ছিলেন একটি দীপ্ত ইতিহাস। আমাদের বাংলায় আঁকার সঙ্গে সাহিত্যকে এমন নিবিড় ভাবে মিলিয়ে দিতে তাঁর মতো আর কে পেরেছেন, আমার জানা নেই।
১৯৬২ সাল থেকে বাংলা কমিকস জগতে বিপ্লব ঘটিয়ে দিতে শুরু করে তাঁর অমর সৃষ্টি ‘হাঁদা–ভোঁদা’। (সাহিত্যিক মানস ভাণ্ডারীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেল, প্রথমে তিনি ভোঁদাকে নিয়ে এই সিরিজ শুরু করেন। পরবর্তী কালে তাতে হাঁদার অনুপ্রবেশ ঘটে। প্রথম দিকে এমন ধারাবাহিকগুলি লিখতেন ‘বোলতা’ ছদ্মনামে।)
আর ১৯৬৫ সালে এলো ‘বাঁটুল দি গ্রেট’। তার পর এলো ‘বাহাদুর বেড়াল’, ‘কেমিক্যাল দাদু’ও। এমন অসামান্য সৃষ্টির জন্য দেব সাহিত্য কুটিরের কর্ণধার সুবোধচন্দ্র মজুমদার তাঁকে বলা যায় বেঁধে ফেললেন নিজেদের প্রকাশনার সঙ্গে। টানা ৬০ বছর ধরে প্রতি মাসে এমন কমিকসের ধারাবাহিক আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল দেব সাহিত্য কুটিরের ‘শুকতারা’য়।
এরই পাশাপাশি তিনি চোখে পড়ে যান দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়েরও। তাঁর অনুরোধে তাঁদের ‘কিশোর ভারতী’ পত্রিকার জন্য তিনি শুরু করেন কমিকস ‘নন্টে ফন্টে’। নন্টে–ফন্টের আগেই অবশ্য সেখানে তিনি ধারাবাহিক কমিক স্ট্রিপ ‘ম্যাজিশিয়ান পটলচাঁদ’ শুরু করে দিয়েছিলেন।
কুড়ি শতকের ছয়ের দশক থেকে শুরু করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাঁর কমিকস গিলেছে ছোট থেকে বড়— সব বয়সের বাঙালিই। তাঁর আগে বাংলা সাহিত্যে একেবারেই যে কমিকস লেখা ও আঁকা হয়নি, তা নয়। আবার তাঁর সময়ে তাঁকে দেখে অনেকে কমিকস নিয়ে আগ্রহীও হয়েছেন। এখনও প্রচুর কমিকস প্রকাশিত হয়।
কিন্তু অপ্রিয় সত্য হল, তাঁর কমিকসের উচ্চতায় পৌঁছতে পারেনি আগের বা এখনকার কোনও চিত্রকাহিনিই। পাঠকের কাছেও এত জনপ্রিয় হয়নি।
বয়সভারে প্রায় শয্যাশায়ী হলেও তাঁর হাত কিন্তু থেমে থাকেনি। এখনও তাঁর চিত্রকাহিনি নিয়মিত প্রকাশিত হত ‘শুকতারা’ থেকে ‘কিশোর ভারতী’র পাতায়। কমিকস তাঁর চিন্তা ও চেতনায় মিশে গিয়েছিল। তার সুফল ভোগ করেছে বাংলা সাহিত্য। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ঠিকই বলেছেন, ‘তিনি একক চেষ্টায় বাংলা সাহিত্যের কমিকসকে একটা সম্মানের জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিলেন।’
শুধু কমিকসই তাঁর জাদুহাত থেকে বের হয়নি, তিনি গল্পও লিখেছেন। আবার অনেক রহস্য, রোমাঞ্চ ও ভৌতিক কিশোর কাহিনির ছবিও এঁকেছেন সমান তালে। দেব সাহিত্য কুটিরের পূজাবার্ষিকীগুলিতে তিনি নিয়মিত ছবি আঁকতেন। সে–সবও সমান জনপ্রিয় হয়েছে।
সন্দেহ নেই, তাঁর প্রয়াণ বাংলা সাহিত্য জগতে মহীরুহ পতনই। যথার্থ কারণেই শোক প্রকাশ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পশ্চিমবাংলার রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে অনেক নেতা–মন্ত্রী এবং সরকারি–বেসরকারি প্রেক্ষিতের মানুষজন।
তাঁকে নিয়ে বিখ্যাতদের পাশাপাশি সাধারণ পাঠকের অপরিসীম আগ্রহও আজ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। বেশ কিছুদিন ধরেই অবশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁকে নিয়ে নানা পোস্ট দেখা গিয়েছে। মঙ্গলবার তো সোশ্যাল মিডিয়া ভরে যায় তাঁর মৃত্যু সংবাদ, শোকবার্তা ও মূল্যায়নে। তাঁর গুণমুগ্ধ অসংখ্য সাধারণ পাঠকই এদিন হেঁটেছেন স্মৃতির সরণি ধরে। শৈশবকে নেড়েচেড়ে দেখেছেন ‘শুকতারা’ বা ‘কিশোর ভারতী’র পাতায়।
সবার মুখে শোনা গিয়েছে এক কথা, যতদিন বাংলা সাহিত্য বেঁচে থাকবে, যতদিন বাংলার চিত্রশিল্প বেঁচে থাকবে, ততদিন বেঁচে থাকবেন নারায়ণ দেবনাথও। সাধারণ পাঠকের এমন প্রতিক্রিয়া নিয়ে কিছু বলার নেই। কারণ, লেখক বা সাহিত্যিকের প্রকৃত মূল্যায়ন তো করবেন পাঠকই।
এই পর্যন্ত হলে ঠিক ছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সরকারি, বেসরকারি মিলিয়ে বহু বিখ্যাত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তরফে তাঁর সম্পর্কে অনেক বড় বড় কথা বলা হচ্ছে। স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে কমিকস দুনিয়ায় তাঁর অবদানকে। তবে এটা অল্প হলেও শুরুটা হয়েছিল কয়েক বছর আগে থেকেই।
ঠিক এই জায়গাতেই আবার প্রকট হয়ে উঠছে আমাদের ভণ্ডামি। সত্যিই, বাঙালির এমন ধ্যাষ্টামো দেখলে গা জ্বলে যায়! ঠিক সময়ে ঠিক মানুষের ঠিক মূল্যায়ন এই জাতি কোনও দিনই করেনি। করে না।
যেমন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য সুইডেনের নোবেল কমিটির তত্ত্ব তালাশ করে না জানালে আমরা জানতেও পারতাম না, বন্দ্যোপাধ্যায় ত্রয়ীকে (মানে আমাদের বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে) নোবেল দেওয়ার কথা ভেবেছিল ওই কমিটি।
কিন্তু বাংলা বা ভারত থেকে কোনও রকম উদ্যোগই নেওয়া হয়নি এ ব্যাপারে। বরং কমিটি যখন বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে, তখন তাঁরা প্রয়াত। আর মরণোত্তর নোবেল তো দেওয়া হয় না! তাই তিন বন্দ্যোপাধ্যায়েরও নোবেল পাওয়া হয়নি। আরও কয়েকজন বাঙালি সাহিত্যিক যে নোবেল পাওয়ার যোগ্য ছিলেন, তাও তো পরবর্তী সময়ে জানা গিয়েছে। কিন্তু বাংলা বরাবরের মতো উদাসীনই ছিল সে ব্যাপারে।
এ ছাড়া, জীবনানন্দ দাশের কথাই ধরুন। বেঁচে থাকতে তাঁকে স্বীকৃতি দেওয়া দূরের কথা, তাঁর লেখাই ছাপতে চাইত না বাংলা পত্রপত্রিকাগুলি। তাঁর কথা বা ভাষাই যেন বুঝতে পারতেন না সেই সময়ের কবিতা সম্পাদকরা। অথচ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতাকে বলেছিলেন ‘দূরগন্ধবহ’। তাঁকে চিনেছিলেন একমাত্র বুদ্ধদেব বসুই। তিনি না থাকলে জীবনানন্দকে আমরা কতখানি পেতাম, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
বেঁচে থাকতে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে জীবন যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হতে হয়েছে জীবনানন্দকে। শেষে ট্রাম লাইনে তাঁকে টেনে নিয়ে যায় তাঁর নিয়তি। অথচ, সেই কবির জন্মশতবর্ষে সেই বাংলা পত্রপত্রিকাগুলিই অতীত ভুলে তাঁর বন্দনা করার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছিল। ভাবতে কি লজ্জা হয় না?
নারায়ণ দেবনাথের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কি তেমন ছায়াই আমরা দেখতে পাচ্ছি না? নতুবা, ২০১৩ সালে যখন তাঁকে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার দেওয়া হল, তখন তাঁর বয়স ৮৮ বছর। ভাবুন! ওই সময়ই তাঁকে বঙ্গবিভূষণ পুরস্কারেও ভূষিত করা হয়। আর ২০২১ সালে পান ভারত সরকারের ‘পদ্মশ্রী’। মানে ৯৬ বছরে! তাও ‘পদ্মবিভূষণ’ বা ‘পদ্মভূষণ’ও নয়!
অথচ হাঁদা–ভোঁদা, বাঁটুল, নন্টে–ফন্টেতে বাঙালি যখন বুঁদ হয়ে গিয়েছে, তখন তাঁর বয়স ছিল ৪০–এর মতো। যদি পঞ্চাশেও তাঁকে পুরস্কারগুলি দেওয়া যেত, তা হলে নারায়ণবাবু হয়তো ব্যাপারটা আরও ভালো ভাবে উপভোগ করতে পারতেন। কারণ, পুরস্কার তো শুধু পুরস্কার নয়, একটা সম্মানও। এক ধরনের স্বীকৃতি।
কে জানে ওই সম্মান তাঁকে আরও নতুন কিছু ভাবতে উৎসাহিত করত! বাংলা সাহিত্য আরও সমৃদ্ধ হত! বরং যে সময়ে তাঁকে এমন সম্মান দেওয়া হয়েছে, তখন তিনি জীবন উপান্তে দাঁড়িয়ে। বাড়ির বাইরে বের হওয়া অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছেন।
তাই, সম্মান পেয়ে তাঁর খারাপ হয়তো লাগেনি, কিন্তু কষ্টও কি তিনি পাননি?
হয়তো তাই শেষ বয়সে সরকারের অনুদানও নিতে চাননি। একটি লেখায় পড়লাম, তিনি নাকি বারবার বলতেন, ‘শেষ পর্যন্ত আমার দুঃস্থ তকমাও জুটল! এই কি আমার প্রাপ্য ছিল?’
হ্যাঁ, তাই। কী প্রাপ্য ছিল তাঁর? কী বলবে বাংলা সাহিত্য জগৎ?